শাহবাগের জাতীয় জাদুঘর আমাদের দেশে জাদুঘরগুলোর মধ্যে বৃহত্তম। কিন্তু এর চাইতেও বড়; পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আর্ট মিউজিয়ামটি (শিল্পকর্ম প্রদর্শনীর জাদুঘর) যদি আপনার শহরে হতো, তাহলে কেমন হতো? কেমন লাগতো ১৫ একরের এক জাদুঘর প্রতিদিনই একটু একটু ঘুরে দেখতে আর প্রতিদিনই অজানা নানা তথ্য জানতে?
প্যারিসে যারা থাকেন, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আর্ট মিউজিয়ামটি হাতের নাগালে পাওয়ার সৌভাগ্যটা তাদেরই। এখন নিশ্চয়ই বুঝতে বাকি নেই কোন জাদুঘরের কথা বলা হচ্ছিলো। প্যারিসে প্রায় ১৫ একর জায়গা জুড়ে অবস্থান করছে বিশ্ব বিখ্যাত ল্যুভর জাদুঘর। এটি বিশ্বের পুরনো জাদুঘরগুলোর একটি। শুধু জাদুঘর নয়, রয়েছে আর্ট গ্যালারিও। মধ্যযুগ থেকে শুরু করে ১৮৪৮ অর্থাৎ ১৯ শতক পর্যন্ত পশ্চিমা শিল্পের এক বিশাল সমাহার রয়েছে ল্যুভরে। পাশাপাশি রয়েছে প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন।
মজার ব্যাপার হলো, দর্শনার্থীরা যে ভবনে শিল্প আর সভ্যতার নিদর্শনগুলো দেখতে যায়, সেটি নিজেই কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তবে এটি ছাড়াও পরে বেশ কিছু স্থাপনা তৈরি হয়েছে। তাই এখানে শুধু শিল্প আর সভ্যতার নিদর্শনগুলো নয়, লক্ষ্য করা যায় ১২ শতক থেকে ২১ শতকের স্থাপত্যের বির্বতের নিদর্শনও।
দুর্গ থেকে রাজপ্রাসাদ
অনেকের মধ্যে একটা ভুল ধারণা কাজ করে যে, ল্যুভরকে জাদুঘর করার জন্যই তৈরি করা হয়েছিলো। আর এ ধারণাটিকে আরো জোরালো করে ল্যুভরে অবস্থিত কাঁচের পিরামিডটি। অনেকের জন্য এটা বিশ্বাস করা কঠিন হতে পারে, যে জাদুঘরে মোনালিসার মতো জগৎ বিখ্যাত চিত্রকর্মের ঠাঁই হয়েছে, সেটি ছিলো প্রকৃতপক্ষে এক দুর্গ। সিন নদীর তিরে আবস্থিত এ দুর্গটিতে পরে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাজা বসবাস করেছেন।
রাজা দ্বিতীয় ফিলিপের শাসনামলে, বারো থেকে তেরো শতকের মাঝে ল্যুভর তৈরি করা হয়, দুর্গ হিসেবে। অনেকের ধারণা, রাজা ফিলিপ অগাস্টের নির্দেশে ১১৯০ সালে দুর্গটির নির্মাণ শুরু হয়। ক্রুসেডের যুদ্ধে যাওয়ার আগে প্যারিস শহরকে ভাইকিং দস্যুদের হাত থেকে রক্ষার জন্য তিনি এ দুর্গ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন। সিন নদী আর শহরের সংযোগস্থলে নির্মিত হয় ল্যুভর। শহরকে বর্হিরাক্রমণ হতে রক্ষার জন্য এই স্থানটি ছিলো গুরুত্বপূর্ণ। ল্যুভরের অবস্থান এখন যেমন শহরের কেন্দ্রে, তখন এর অবস্থান এমন ছিলো না। এর অবস্থান ছিলো শহরের বাইরের দিকে আর এর কাজ ছিলো শহরের উপর প্রতিরক্ষামূলক নজরদারি করা।

পঞ্চশ চার্লসের সময় ল্যুভর (১৩৮০); Sketch: Theodor Josef Hubert Hoffbauer
তবে পরবর্তীতে নগরের পরিধি বাড়ার ফলে প্রতিরক্ষার কাজে এ দুর্গটি আর ব্যবহৃত হয়নি। এখনও জাদুঘরের বেইসমেন্টে (ভবনের সর্বনিম্ন তলা, যা ভূগর্ভস্থ) পুরনো সেই দুর্গের অংশ দেখা যায়, যা সেইন্ট লুইসের (১২২৬-৭০) আমলে তৈরি। বিভিন্ন নথিপত্র ও এর আগের নকশা বিশ্লেষণ করে বলা যায়, ফিলিপ অগাস্ট যে ল্যুভর তৈরি করেছিলেন, সেটিকে কোনোভাবেই রাজপ্রাসাদ বলা চলে না, বরং এটি ছিলো পুরোদস্তর গ্যারিসন।

ল্যুভরের আদি নকশা; Source: Plan of medieval Louvre - Berty 1866
১৫৪৬ সালে রাজা প্রথম ফ্রান্সিস এতে থাকার ব্যবস্থা করে প্রাসাদ হিসেবে ব্যবহার শুরু করেন। এরপর থেকেই পর্যায়ক্রমে এটি ফরাসি রাজাদের প্রাসাদ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে। প্রথম ফ্রান্সিসের সময় বর্তমানে যে প্রাসাদটি দেখা যায় তার অল্পই তৈরি হয়েছিলো। তার আমলে ল্যুভরের কাজ হয়েছিলো পিয়েরে লেসটের তত্ত্বাবধায়নে। ল্যুভরের বেশিরভাগ কাজ হয়েছিলো সতের শতকে ত্রয়োদশ লুইস ও চতুর্দশ লুইসের সময়। তাদের দুজনেরই শিল্পের প্রতি বিশেষ অনুরাগ ছিলো। তাদের মন্ত্রীগণ তাদের জন্য নানা স্থান থেকে মূল্যবান শিল্পকর্ম সংগ্রহ করতো। ১৬৪২ সালে চতুর্দশ লুইস ল্যুভরকে রাজসংগ্রহ প্রদর্শনীর জন্য ছেড়ে দিয়ে ভার্সিলিসে চলে যায়। তখন ল্যুভরে ঠাঁই হয় বিভিন্ন আর্ট একাডেমির। এই একাডেমিগুলো নিয়মিত তাদের সদস্যদের শিল্পকর্মের প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করতো।

১৫ শতকের ল্যুভর; Source: Très Riches Heures du Duc de Berry
ল্যুভরকে জাদুঘর হিসেবে ব্যবহার শুরু হয় ১৮ শতকে। ফরাসি বিপ্লবের সময় চতুর্দশ লুইস ও তার স্ত্রীকে টুইলারিস প্রাসাদে কারারুদ্ধ করা হয় এবং ১৭৯৩ সালে সেখানেই তাদের শিরোচ্ছেদ করা হয়। টুইলারিস প্রাসাদটি ছিলো ল্যুভর সংলগ্ন। সে বছরই আগস্টে ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির নির্দেশে ল্যুভরকে জাদুঘর হিসেবে সকলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। ৫৩৭টি চিত্রকর্ম নিয়ে ল্যুভর আনুষ্ঠানিকভাবে গণ-জাদুঘর হিসেবে এর যাত্রা শুরু করে।

ল্যুভরের দক্ষিণ প্রবেশদ্বার; Sketch: Israël Silvestre, c. 1650
নেপোলিয়নের সময় ল্যুভরের সংগ্রহ ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পায়। ফরাসি সৈন্যদের লুট করা সব শিল্পকর্ম আসতো এখানে। সেই সময়ে তিনি ল্যুভরকে নিজের নামে নামকরণও করেন। তবে ১৮১৫ সালে নেপোলিয়ানের পরাজয়ের পর অনেক বস্তুই তার প্রকৃত মালিকের কাছে ফিরিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু এ কথা না বললেই নয় যে, এখন ল্যুভরে মিশরীয় পুরাকীর্তি বিভাগসহ অন্যান্য বিভাগ সমৃদ্ধ হয়েছে নেপোলিয়নের অভিযানগুলোর ফলে।

১৮৫৯ সালে ল্যুভর © Gustave Le Gray
ল্যুভর নিয়ে অজানা ও চমকপ্রদ কিছু তথ্য
বিখ্যাত চিত্রকর্ম মোনালিসা এতটাই দামী যে এটি চারদিক থেকে বুলেট প্রুফ কাঁচে ঘেরা এবং এটি পাহারা দেয়ার জন্য দেহরক্ষীর মতো সবসময় প্রহরী থাকে। তারপরও ১৯১১ সালে এটি চুরি হয়েছিল এবং দু’বছর পর পুনরুদ্ধার করা হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসি বাহিনী ল্যুভরকে চুরি করা শিল্প সামগ্রীর সংরক্ষণাগার হিসেবে ব্যবহার করতো।
জাদুঘরে অনেক না-দেখা বস্তু দেখা যায়, তবে জাদুঘরে যে ভুত দেখা যায় তা কি আগে কখনও শুনেছেন? লুভরে বেলফেগার নামের এক মমি আছে। শোনা যায়, প্রতি রাতে নাকি এটি জাদুঘরে ঘুরে বেড়ায়।
ল্যুভরের সামনে যে কাঁচের তৈরি পিরামিডটি দেখা যায় সেটি ছাড়াও আরো তিনটি ছোট পিরামিড রয়েছে।
ল্যুভরের সংগ্রহে ৩৮০,০০০ বেশি দর্শনীয় বস্তু রয়েছে; কিন্তু এর সব প্রদর্শিত হয় না।
নেপোলিয়ানের শাসনামলে, মোনালিসার চিত্রকর্মটি ল্যুভর থেকে সরিয়ে নিজের শোবার ঘরে রেখেছিলেন তিনি।