
স্টিভ ওজনিয়াক, অ্যাপলের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। তিনি ও স্টিভ জবস মিলে শূন্য থেকে গড়ে তুলেছিলেন আজকের টেক-জায়ান্ট প্রতিষ্ঠানটিকে। সম্প্রতি স্যামসাংয়ের বার্ষিক প্রযুক্তি দিবসে অতিথি হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। অংশ নিয়েছিলেন স্যামসাংয়ে সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট জিম এলিয়টের সাথে আলাপচরিতায়। ওজনিয়াক টপিক থেকে টপিকে টপকে বেড়িয়েছেন, বলেছেন নতুন-পুরানো অনেক গল্প।

স্যামসাংয়ের অনুষ্ঠানে ওজনিয়াক; Image Source: Tekla Perry/IEEE Spectrum
যেভাবে ইতিহাসবিদদের বোকা বানিয়েছিলেন
২৯শে জুন, ১৯৭৫, কম্পিউটারের ইতিহাসে বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন। এ দিনে স্টিভ ওজনিয়াক প্রথমবারের মতো স্টিভ জবসকে ‘অ্যাপল-১’ কম্পিউটারের প্রোটোটাইপ দেখিয়েছিলেন। এদিনেই প্রথম কেউ একজন পার্সোনাল কম্পিউটারের কী-বোর্ডে কিছু টাইপ করে, যা স্ক্রিনে ভেসে ওঠে। এ দিনটির গুরুত্ব বুঝতে এ সম্পর্কে দ্য কাল্ট অব ম্যাক ওয়েবসাইটের উক্তিটি শোনা যাক, “এটি স্রেফ অ্যাপলের বীজ বপনের মুহূর্তই নয়, বরং এর ধারাবাহিকতা অনুসরণ করে আসা ম্যাক, আই-ফোন, আই-প্যাড সহ কনজ্যুমার-প্রযুক্তির গোটা দুনিয়ার জন্যেই এটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলোর একটি।”

স্টিভ জবস ও ওজনিয়াক; Image Source: Kimberly White / REUTERS
কম্পিউটারের জন্য ছাড়তে হয়েছিল কলেজ
ওজনিয়াক তার কলেজের প্রথম বর্ষ পড়েছেন কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখানে বেশ মজার একটি ঘটনা আছে তার। এখানে এসে কম্পিউটার ব্যবহারের সুযোগ পান তিনি। ডর্মে ডিশ-ওয়াশার হিসেবে কাজ করে কিছু অতিরিক্ত অর্থ-কড়িও আয় করতেন। সে টাকা দিয়ে কম্পিউটারের ম্যানুয়াল কিনতেন, শিখতেন কীভাবে কাজ করতে হয় কম্পিউটারে। এরপর উৎসাহের সাথে নিজের এ জ্ঞানকে কাজে লাগাতেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটারে।
প্রোগ্রামিং ক্লাসে বসে বসে প্রোগ্রাম লিখতেন রসায়ন, পদার্থবিজ্ঞানের বই থেকে নানা টেবিলের হিসাব নিকাশ করতে। এরপর প্রিন্টও করে নিতেন সেসব। দিস্তার পর দিস্তা প্রিন্টেড কাগজ জমিয়ে ফেলেছিলেন তিনি। স্মরণ রাখা দরকার যে, সে সময়ের কম্পিউটার প্রযুক্তি বর্তমানের মতো ছিল না। সে সময় কম্পিউটার ব্যবহার করা ছিল অনেক ব্যয়বহুল ব্যাপার। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে তাই ওজনিয়াকের এ পাগলামি থামাতে পদক্ষেপ নিতে হয়েছিল। কারণ, তার ক্লাসের কম্পিউটারের ব্যয় বাজেটের চেয়ে পাঁচগুন বেশি হয়ে গিয়েছিল। এ ব্যয়ের অধিকাংশ কার কারণে হয়েছিল তা কি আর বলে দিতে হবে?

তরুণ ওজনিয়াক; Image Source: Steve Castillo/The Associated Press
তরুণ প্রকৌশলীর অনুপ্রেরণা যখন লাস ভেগাস
অ্যাপলের কর্মকর্তাদের সভা চলছিল। ওজনিয়াক জানতে পারলেন ভেগাসে অনুষ্ঠিত হওয়া কনজ্যুমার ইলেকট্রনিক্স শো-তে (CES) প্রথমবারের মতো অংশ নেওয়ার সুযোগ পাচ্ছে অ্যাপল। একে তো সিইএস, তার উপর অনুষ্ঠিত হচ্ছে লাস ভেগাসে। তিনি আগে কখনো ভেগাস দেখেননি। এ সুযোগ তো কোনোভাবেই হাতছাড়া করা চলে না। কিন্তু অ্যাপলের সিইও মাইক মারকুলা জানালেন তারা মাত্র তিনজনকে পাঠাবেন এ অনুষ্ঠানে। সে তালিকায় ছিল না ওজনিয়াকের নাম।

স্টিভ ওজনিয়াক; Image Source: dezeen.com
ওজনিয়াক সেবার ভেগাসে গিয়েছিলেন। দুর্দান্ত সময়ও কাটিয়েছিলেন। স্টিভ জবসকে শিখিয়েছিলেন কীভাবে ক্র্যাপস খেলতে হয়।
ভিডিও গেম ও হাই-স্কোর
স্মৃতিচারণ করতে করতে ওজনিয়াক ফিরে গিয়েছিলেন সেই ভিডিও গেম খেলার দিনগুলোতে। বিখ্যাত নিনটেন্ডো গেমবয়ে আসক্ত ছিলেন তিনি। এ গেম কনসোলটিতে হাই-স্কোর করলে নামসহ ছবি প্রকাশ করা যেত ‘নিনটেন্ডো পাওয়ার ম্যাগাজিনে’। হাই-স্কোর করে ক্যামেরায় তার ছবি তুলে পাঠাতে হতো ম্যাগাজিনের অফিসে। ভিডিও গেমেও দুর্দান্ত ছিলেন ওজ। শীর্ষস্থানে সবসময় তার নামটিই থাকতো।

নিনটেন্ডো গেমবয়; Image Source: amazon.com
পরবর্তীতে তার সবচেয়ে পছন্দের গেম ছিল ‘ব্রেকআউট’। স্টিভ জবসের জন্যে এ গেমটি তিনি নিজেই তৈরি করেছিলেন। জবস এর জন্যে চুক্তি করেছিলেন বিখ্যাত ভিডিও গেম নির্মাতা প্রতিষ্ঠান আটারির সাথে। ওজনিয়াক বলেন, “ব্রেকআউটে আমি চ্যাম্পিয়ন ছিলাম। এটি এমন পর্যায়ে গিয়েছিল যে, আমি প্রায় মিলিয়নেরও বেশি স্কোর করতে পারতাম। কিন্তু এখানে গেলে গেমটিতেই ঝামেলা বেঁধে যেত।”
শৈশবে যেভাবে নিক্সনকে বোকা বানিয়েছিলেন
ওজনিয়াকের ব্যক্তিত্বের এ মজার দিকটা অনেকটাই তার মায়ের কাছ থেকে পাওয়া। তার মায়ের হাস্যরসিকতার পরিচয় পাওয়া যায় তার ছোটবেলার একটি ঘটনা থেকে। এ ঘটনাটির উল্লেখ আছে ওজনিয়াকের আত্মজীবনিমূলক বই ‘আইওজ’-এ। ১৯৬২ সালের কথা, ওজনিয়াক তখন সবে সিক্সথ গ্রেডে। সে সময় ক্যালিফোর্নিয়া থেকে গভর্নর পদে প্রার্থী হয়েছিলেন রিচার্ড নিক্সন। ওজনিয়াকের মা জড়িত ছিলেন রিপাবলিকান রাজনীতির সাথে। স্বাভাবিকভাবেই তিনি ছিলেন কট্টর নিক্সন সমর্থক। নিক্সনের এক বক্তৃতায় তিনি সাথে করে নিয়ে গেলেন ওজনিয়াককেও।

রিচার্ড নিক্সন; Image Source: upi.com
এখানে মজার বিষয় হলো ওজনিয়াক ছিলেন তার স্কুলে একমাত্র হ্যাম রেডিও অপারেটর। গোটা প্রদেশে হয়তো সবচেয়ে কনিষ্ঠ অপারেটর ছিলেন। নিক্সনের জন্যে কাজ করা এমন কোনো দলের কোনো অস্তিত্বই ছিল না কোনোকালে। যে স্মারকলিপিটি ওজ নিক্সনকে দিয়েছিলেন, তা সভায় যাবার আগে তিনি ও তার মা মিলে লিখেছিলেন। কিন্তু তাদের এ কৌতুকটি ধরতে পারেনি কেউ। এ ঘটনাটি ওজনিয়াককে অভিভূত করে তুলে। তিনি সেদিনই প্রথম টের পেরেছিলেন যে, কত অদ্ভুত অদ্ভুত বিষয়ও বিশ্বাস করে ফেলে মানুষ।
ওজনিয়াক এখন কী করছেন?

রাস্পবেরি পাই; Image Source: raspberrypi.org
স্যামসাংয়ের এ সম্মেলনে ওজনিয়াক জানিয়েছেন তার বর্তমান কাজের কথাও। জানিয়েছেন, বহুদিন পর আবার শেকড়ে ফিরে গিয়েছেন তিনি। খুব সম্প্রতি অনেকগুলো রাস্পবেরি পাই কিনে নিয়ে ছোটখাটো সব প্রজেক্ট করে চলছেন। রাস্পবেরি পাই ক্ষুদে কম্পিউটার ধাঁচের প্রযুক্তি। আমাদের দেশে শখের বসে ইলেকট্রনিকস নিয়ে কাজ করা ছেলে মেয়েরাও এটি নিয়ে কাজ করে এখন। ওজনিয়াকও ফিরে গিয়েছেন সেখানে। তার মতো একজন ব্যক্তির জন্যে এ ধরনের কাজের চেয়ে আনন্দের বিষয় আর কী হতে পারে!
ওজনিয়াক বলেন, “অ্যাপলের সাফল্যের ফলে আমি প্রায় তিরিশ বছরের মতো কিছুটা বিচ্যুত হয়ে গিয়েছিলাম।” অ্যাপলকে তিনি ভালোবাসেন। অ্যাপলের সাফল্য নিয়ে গর্বও করেন। কিন্তু একদম শূন্য থেকে কোনোকিছু গড়ে তোলা, আসক্তের মতো রাত-দিন প্রোগ্রামিং করে চলা যে স্টিভ ওজনিয়াক তাকে এখানে খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই এখন তাকেই খুঁজে চলছেন তিনি।