ক্রিস্টোফার কলম্বাস, যাকে আমেরিকা মহাদেশের আবিষ্কারক নামে সবাই জানেন। তিনি ভারতীয় উপমহাদেশের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে ভুলবশত আমেরিকার ভূখন্ড আবিষ্কার করে ফেলেন। আমেরিকায় ইউরোপিয়দের শাসন প্রতিষ্ঠায় ও আধুনিক সভ্যতার সূচনায় যার ভূমিকা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি ছিলেন সৃষ্টিকর্তার উপর আস্থাবান, একজন ঈশ্বর পূজারী। ভাগ্যচক্রে সামান্য একজন তাঁতী থেকে ‘সাগর-মহাসাগরের নৌ সেনাপতি’ (Admiral of the Ocean Sea) রূপে আবির্ভাব ঘটে তার। আমেরিকার ভূখণ্ডের আবিষ্কারক হিসেবে ইতিহাসের পাতায় একটি বড় অংশ দখল করে সারা দুনিয়া জুড়ে অনেক সম্মান কামিয়েছেন কলম্বাস।

ক্রিস্টোফার কলম্বাস; Image Source: independent.co.uk
প্রথমেই বলে রাখা ভালো, কলম্বাস আমেরিকা মহাদেশে আসা প্রথম ইউরোপিয়ান নন। বেশ কিছু তথ্যমতে, তারও ৫০০ বছর আগে লেইফ এরিকসন নামের আইসল্যান্ডের একজন পরিব্রাজক উত্তর আমেরিকায় পা রাখেন। ১৫ শতকের দিকে স্পেনের আর্থিক অবস্থা অন্যান্য ইউরোপীয় রাষ্ট্রের মতো তেমন উন্নত ছিল না। তাই তারা ভাবলেন, যদি তারা তাদের স্বর্ণের পরিমাণ বাড়াতে পারেন তাহলে হয়তো তাদের অনেক লাভ হবে।
অন্যদিকে কলম্বাসও অজানা ভূখণ্ডের সন্ধানে গিয়ে অনেক টাকা ও সুনাম কামানোর জন্য অনেক উদগ্রীব ছিলেন। সেই সুযোগটা কাজে লাগিয়ে তখনকার স্পেনের রাজা- রানীকে ভারতীয় উপমহাদেশের উদ্দেশ্যে যাত্রার জন্য সাহায্য আবেদন করলেন এবং অনেক স্বর্ণ ও মূল্যবান মসলা সামগ্রী এনে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেন। প্রতিদানে স্পেনের শাসক কলম্বাসকে লাভের ১০ শতাংশ ও নতুন আবিষ্কৃত ভূমির গভর্নর পদ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেন। কলম্বাস তিনটি জাহাজ নিয়ে রওনা দিলেন এবং ভুলবশত আমেরিকার বাহামাস দ্বীপে পৌঁছালেন। দিনটি ১৪৯২ সালের ১২ অক্টোবর, যা কলম্বাস দিবস হিসেবে পালিত হয়।

কলম্বাসকে স্বাগত জানাচ্ছে আরাওয়াকদের দল; Image Source: telegraph.co.uk
আদিবাসীরা তখন অলংকার পরতেন। এটি কলম্বাস লক্ষ্য করেন। মনে মনে ভাবলেন, এখানে নিশ্চয়ই অনেক স্বর্ণ পাওয়া যাবে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কোথায় সেই স্বর্ণ? সেটি খুঁজতে তিনি কয়েকজন ইন্ডিয়ানকে বন্দী বানিয়ে জাহাজ নিয়ে গেলেন। প্রথমে কিউবায়, তারপর হিস্পানিওলাতে (বর্তমান হাইতি ও ডমিনিকান ডিপাবলিক )। কলম্বাস আমেরিকার প্রথম ঘাঁটি বানান হিস্পানিওলাকে।
সেখানে দলের ৩৯ জনকে রেখে স্পেনের উদ্দেশ্যে বাকি দুটি জাহাজ নিয়ে রওনা দেন তিনি। যেকোনো মূল্যে স্বর্ণের খোঁজ করতে নির্দেশ দেয়া হয়। কলম্বাস তার জাহাজে আরো কয়েকজন ইন্ডিয়ানকে বন্দী করে স্পেনে নিয়ে যান। একটি ঘটনা না বললেই নয় যে, ফেরত আসার পূর্বে স্থানীয় কিছু তাইনোদের সাথে তীর-ধনুক নেয়া নিয়ে কলম্বাসের কথা কাটাকাটি হয়, যার পরিপ্রেক্ষিতে তার নির্দেশে দুজন আদিবাসীকে তলোয়ারের আঘাতে মেরে ফেলা হয়।
এদিকে স্পেনে ফিরে এসে কলম্বাস অনেক মনোমুগ্ধকর তথ্য দেন রাজা-রানীকে। যার বেশির ভাগই ছিল মিথ্যা। তিনি তাদের জানান, তিনি এশিয়া পৌঁছেছেন ও চীনের একটি দ্বীপে তিনি ঘাঁটি বানিয়েছেন এবং সেখানে অনেক স্বর্ণ ও মসলা সামগ্রী রয়েছে, যার জন্য তার আরো বড় দল প্রয়োজন। এজন্য তিনি ১৭টি জাহাজ ও প্রায় ১,২০০ লোক নিয়ে আমেরিকার উদ্দেশ্যে রওনা দেন। এরপর থেকে শুরু হলো আরাওয়াকদের (যারা তাইনো নামেও পরিচিত) উপর আসল নির্মমতা।

আরাওয়াকদের উপর হওয়া নির্মম অত্যাচার; Image Source: mic.com
হিস্পানিওলার একটি প্রদেশে ১৪ বছরের উপরের সব স্থানীয় ইন্ডিয়ানকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ সোনা তিন মাস পরপর জমা দেওয়ার আদেশ করেন কলম্বাস। যারা এতে ব্যর্থ হয় তাদের দুই হাত কেটে ফেলা হতো এবং ফলশ্রুতিতে রক্তপাতে তারা মারা যেত। অনেকে সহ্য করতে না পেরে পালানোরও চেষ্টা করতো। তাদেরকে হিংস্র কুকুর দিয়ে খুঁজে বের করে মেরে ফেলা হতো। যাদেরকে বন্দী করা হতো তাদেরকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে অথবা আগুনে পুড়িয়ে মারা হতো।
এত নির্মমতা সইতে না পেরে আরাওয়াক গোষ্ঠীর লোকরা বিষ পানে গণ-আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। মায়েরা তাদের ছোট ছোট বাচ্চাদের বিষ খাইয়ে মেরে ফেলে, যাতে স্প্যানিশরা সেসব বাচ্চাদেরকে কুকুরের খাবারে পরিণত করতে না পারে। এভাবে নানা উপায়ে প্রায় ৫০ হাজার আদিবাসী আত্মহত্যা করে। খুন, অঙ্গহানী ও আত্মহত্যার কারণে মাত্র দুই বছরে হাইতির ২ লক্ষ ৫০ হাজারের অর্ধেক জনসংখ্যা লাশে পরিণত হয়, যার সবকিছুই ঘটে শুধুমাত্র স্বর্ণ উত্তোলনেকে কেন্দ্র করে।

আদিবাসী শিশুদের হত্যা; Image Source: watchingthewheelsdad.net
কলম্বাসের আবির্ভাবের পর ইন্ডিয়ান আদিবাসীদের সাথে যে অত্যাচার সংঘটিত হয়েছে তার অনেক তথ্য উঠে এসেছে কলম্বাসের নিজস্ব জার্নাল ও বিভিন্ন চিঠির মাধ্যমে। আরো বিশদ ইতিহাস জানা যায় ফাদার বার্তোলমে দে লাস কাসাস নামক একজন স্প্যানিশ ঐতিহাসিকের লেখা ‘হিস্টোরি অব দ্য ইন্ডিস’ এ। তিনি বেশ কয়েক বছর কলম্বাসের সাথে কাজ করেছিলেন। এমনকি কলম্বাসের ব্যক্তিগত যে জার্নাল ছিল, যেখানে কলম্বাস নিজের হাতে সব ঘটনার বর্ণনা লিখেছেন, সেই জার্নালটিও লাস কাসাসের কাছে পরবর্তীতে প্রদান করা হয়।
ফাদার বার্তোলমে একসময় কলম্বাসকে নিজের আদর্শ ভাবতেন। কিন্তু যখন তিনি আস্তে আস্তে দেখলেন, কলম্বাস একটির পর একটি অপরাধ করেই যাচ্ছেন, তখন তিনি কলম্বাসের সঙ্গ ছেড়ে আদিবাসীদের আসল তথ্য তুলে ধরার কাজ শুরু করলেন। তাদের উপর হওয়া নির্মমতার চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করলেন। সেজন্য তাকে 'ইন্ডিয়ানদের রক্ষাকারী' বলে অভিহিত করা হয়। তার ভাষ্যমতে, স্প্যানিশরা তাদের ছুরি কিংবা তলোয়ারের ধার পরীক্ষা করার জন্য ইন্ডিয়ানদেরকে টুকরো টুকরো করে কাটতো। এমনকি একদিন দুটি ছোট্ট আদিবাসী শিশুর হাত থেকে পাখি ছিনিয়ে নিয়ে কোনো কারণ ছাড়াই সেই শিশু দুটির শিরচ্ছেদ করে তারা।

বার্তোলমে দে লাস কাসাস; Image Source: thoughtco.com
একপক্ষের কাছে ছিল আধুনিক, অত্যন্ত ফলপ্রসূ হাতিয়ার এবং অন্য পক্ষের কাছে ছিল হাতে বানানো, সামান্য অলাভজনক হাতিয়ার। এতে আমেরিকার আদিবাসী ইন্ডিয়ানরা স্প্যানিশদের সাথে পেরে উঠতে পারেনি। তাদেরকে কেউ সাহায্য করতে এগিয়েও আসেনি। এদিকে কলম্বাসের কর্মকান্ডের জন্য তাকে ও তার ভাইদেরকে যখন গ্রেফতার করে শাস্তির জন্য স্পেনের রাজা-রানীর সামনে হাজির করা হলো, তখন স্বর্ণ ও ক্রীতদাস লাভের অজুহাত দেখিয়ে কলম্বাস ও তার ভাইদেরকে ক্ষমা করে ছেড়ে দেয়া হয়। ক্রিস্টোফার কলম্বাস তার অপরাধের জন্য কখনো শাস্তিভোগ করেননি।
হয়তো সেজন্যই ইতিহাসের পাতায় যুগান্তকারী নায়ক হিসেবে তার পরিচয়। বাহামাস, হিস্পানিওলা ও কিউবার লাখ লাখ আদিবাসী ইন্ডিয়ানদের উপর করা অত্যাচারের কোনো বিচার হয়নি। উল্টো স্কুলের ইতিহাসের বইগুলোতে তাকে একজন মহান ব্যক্তিত্ব হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। জাঁকজমক করে কলম্বাস দিবস পালন করা হয়। নতুন প্রজন্মের কাছে অজানা থেকে গেছে তার কালো অধ্যায়।