
২০১৯ সালের ৩ জানুয়ারি রোবটচালিত চীনা মহাকাশযান চাং’ই-৪ (Chang’e 4) চাঁদের দূরবর্তী অংশের (Far Side) মাটিতে পা রেখেছে। দ্য চায়না ন্যাশনাল স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (CNSA) এ খবরের সত্যতা নিশ্চিত করেছে। মহাকাশযানটি দক্ষিণ মেরুর এইটকেন বেসিনে (Aitken Basin) অবতরণ করেছে। চাঁদের বুকে এটিই সবচেয়ে বড়, গভীর এবং পুরনো খাদ। ধারণা করা হয়, চাঁদ গঠিত হওয়ার সময় ভয়াবহ কোনো সংঘর্ষের ফলে খাদটি তৈরি হয়েছিল।

টাইডাল লকিং। চাঁদ পৃথিবীর চারপাশে একমুখীভাবে ঘুরছে; Image Source: SihirliFasulyeler.com
চাঁদের বুকে যারা পা রেখেছিলেন, তারাও চাঁদের পৃথিবীমুখী অংশে নেমেছেন, তারপর ওপাশে গিয়ে সেই অংশগুলো মানচিত্রে যুক্ত করেছেন। অর্থাৎ চাঁদের উল্টোপাশে মানুষের পাঠানো প্রথম মহাকাশযানও এই চাং’ই-৪।

৭ ডিসেম্বর, ২০১৮। চাঁদের উদ্দেশ্যে যাত্রা করছে চাং’ই-৪; Image Source: nytimes.com
চীনা মহাকাশযান চাং’ই-৪ চাঁদের সবচেয়ে দূরবর্তী অঞ্চলে অবতরণ করেছে, যা মানুষের চন্দ্র অনুসন্ধান গবেষণায় এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করলো।
দুই ঘন্টা পরে আনুষ্ঠানিকভাবে খবরের সত্যতা নিশ্চিত করে সরকারি সংবাদমাধ্যম CCTV। তাদের বিবৃতি থেকে জানা যায়, চাং’ই-৪ বেইজিং সময় অনুযায়ী বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা ২৬ মিনিটে চাঁদের মাটি স্পর্শ করেছে। কম্যুনিস্ট পার্টির সংবাদমাধ্যম গ্লোবাল টাইমস-ও খবরের সত্যতা নিশ্চিত করেছে।

চাঁদের অপর পাশের এখন পর্যন্ত সবচেয়ে ক্লোজআপ ছবিটি তুলেছে চাং’ই-৪; Image Source: CNSA
চাং’ই-৩ যখন ২০১৩ সালে চাঁদে নেমেছিল, তখন সে চাঁদের বুকে প্রচুর ইলমেনাইট (Ilmenite) সমৃদ্ধ নতুন এক ধরনের ব্যাসাল্টিক পাথর আবিষ্কার করে। যেহেতু চাং’ই-৪ এইটকেন বেসিনে অবতরণ করেছে এবং বিজ্ঞানীদের ধারণা অনুযায়ী, এ খাদটি চাঁদ গঠিত হওয়ার সময় তৈরি হয়েছে। তাই আশা করা যাচ্ছে, মহাকাশযানটি চাঁদ কিভাবে তৈরি হয়েছে এ ব্যাপারে নতুন এবং উল্লেখযোগ্য কোনো তথ্য দিতে পারবে। বিবিসির তথ্যানুযায়ী,
একটি 'মিনি বায়োস্ফেয়ার' বা জীবমন্ডল তৈরি করে সেখানে আলু ফলানো কিংবা রেশমগুটি জন্মানো যায় কিনা, তা নিয়েও পরীক্ষা চালাবে চীন।
চাঁদের উল্টোপাশে মহাকাশযান পাঠানো নিয়ে সবচেয়ে বড় সমস্যাটি ছিল যোগাযোগ। কারণ উল্টোপাশ থেকে যে সিগন্যাল পাঠানো হবে, চাঁদ নিজেই সেটিকে পৃথিবীতে পৌঁছাতে বাধা দিবে। একইভাবে পৃথিবী থেকে পাঠানো সিগন্যালও সেখানে পৌঁছাবে না। সেজন্য রিলে স্যাটেলাইট দরকার, যেটি চাঁদ আর পৃথিবীর মাঝখানের এমন কোন অংশে অবস্থান নেবে, যাতে দুই জায়গাতেই সিগন্যাল পাঠাতে এবং গ্রহণ করতে পারে। সেজন্য ২০১৮ সালের ২০ মে চিন কোয়েকিয়াও নামে একটি রিলে স্টেশন পাঠায়।

আলতেয়ার এবং ভেগা ম্যাগপাই ব্রিজে ভর করে বছরে কেবল একটি দিনেই মিলিত হতে পারে, Image Source: Long Corridor of the Summer Palace in Beijing, Public Domain
যেহেতু পৃথিবী আর চাঁদের উল্টোপাশের অংশটির মাঝে কোয়েকিয়াও সেরকম একটি যোগাযোগ সেতুই তৈরি করবে, সেজন্যই এমন নামকরণ। ৪২৫ কেজি ওজনের এই স্যাটেলাইটটি বর্তমানে সফলভাবে নির্দিষ্ট জায়গায় অবস্থান করছে এবং এটিই পৃথিবীর সাথে চাং’ই-৪ এর যোগাযোগ বজায় রেখেছে। শুধু তাই নয়, চাং’ই-৪ মিশনের অংশ হিসেবে ৪৫ কেজি ওজনের ছোট দুটি মাইক্রোস্যাটেলাইটও পাঠিয়েছিল চীন। তবে এর মাঝে লংজিয়াং-১ সফলভাবে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারেনি। লংজিয়াং-২ গন্তব্যে পৌঁছেছে এবং সফলভাবে দায়িত্ব পালন করছে।
নাসা অ্যাডমিনস্ট্রেটর জিম ব্রিন্ডেস্টাইন চীনাদের এই অর্জনকে ‘দারুণ এক অর্জন’ বলে আখ্যা দিয়ে টুইট করেছেন। এদিকে অস্ট্রেলিয়ান স্পেস এজেন্সি শুধু অভিবাদন জানানো ছাড়া এ ব্যাপারে আর তেমন কিছু বলতে রাজি হয়নি। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ান স্ট্র্যাটিজিক পলিসি ইন্সটিটিউটের জ্যেষ্ঠ প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক ম্যালকম ডেভিস চীনকে অভিবাদন জানিয়ে বলেছেন,
এটি শুধু বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারই নয়, এর সাথে ভূ-রাজনীতি এবং মহাকাশ-রাজনীতির গভীর সম্পর্ক রয়েছে। চীন মূলত নিজেদেরকে বিশাল এক পরাশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যই এসব করছে। চাং’ই-৪ এর এই সফল অবতরণ আমেরিকানদেরকে ভালোরকম ধাক্কা দেবে। সম্ভাবনা আছে, ২০৩০ সালের মধ্যেই চাঁদে মানুষ পাঠানোর ঘোষণাও দিবে চীন। আমেরিকানদের পর দ্বিতীয় জাতি হিসেবে চাঁদের মাটিতে কোনো চৈনিক মানবের পায়ের ছাপ পড়বে— এই ধারণা তাদের ঠিক পছন্দ হওয়ার কথা না।
আসলে আমেরিকার উদ্বেগের পেছনে যথেষ্ট কারণও আছে। বিবিসির তথ্যানুযায়ী, ২০১৮ সালে মহাকাশের বুকে চীনই সবচেয়ে বেশি রকেট পাঠিয়েছে। সংখ্যাটা কত হতে পারে বলে মনে হয় আপনার? না, ১০-২০টি নয়, সংখ্যাটি হচ্ছে ৩৮! এর আগে এক বছরে সর্বোচ্চ সংখ্যক রকেট পাঠানো হয়েছিল মাত্র ২২টি। রেকর্ডটি ২০১৬ সালের। এতগুলো রকেট পাঠানো এবং অন্যান্য কর্মকান্ড সবকিছু মিলে মহাকাশ কর্মসূচীর পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের খরচ হয়েছিল ৩৬ বিলিয়ন ডলার। অথচ সেবছর চীনের খরচ ছিল ৫ বিলিয়নের ডলারেরও কম! চীন যে কত দ্রুত উন্নতি করছে, এখান থেকে তার একটি ধারণা পাওয়া যায়। তাছাড়া, যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ার পরে তৃতীয় দেশ হিসেবে নিজেদের মহাকাশযানে করে মহাকাশে নভোচারীও পাঠিয়েছে চীন। নভোচারীদেরকে নিয়ে প্রথম চৈনিক মহাকাশযানটি ঘুরে এসেছিল ২০০৩ সালে। এরপর এ পর্যন্ত ১১ জন চীনা মহাকাশ ভ্রমণ করেছেন।
এদিকে ২০১১ সালে টিয়াংগং-১ দিয়ে মহাকাশ স্টেশন স্থাপন করা শুরু করেছে চীন। টিয়াংগং শব্দের অর্থ ‘স্বর্গের প্রাসাদ’। ২০১২ সালে একজন চীনা মহিলা নভোচারীও সেই স্বর্গের প্রাসাদ থেকে ঘুরে এসেছেন। এরপর ২০১৬ সালে দুজন নভোচারী সেখানে একমাস কাটিয়ে এসেছেন।

চাঁদের বুকে অবতরণের সময় চাং’ই-৪ এর তোলা ছবি, Image Source: CNSA
মহাকাশ নিয়ে চীনের এত আগ্রহের পেছনে একটি বড় কারণ হলো চিন মহাকাশে সামরিক আধিপত্য বিস্তার করতে চায়। চীন তাদের উদ্দেশ্য স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছে। তারা চাঁদকে দক্ষিণ চীন সাগর এবং তাইওয়ানের সাথে আর গ্রহাণুদেরকে পূর্ব চীন সাগরের সাথে তুলনা করেছে। মহাকাশে যা ঘটছে, তার সাথে তারা ভূ-রাজনীতিকে ভালোভাবে তুলনা করেই সামনে এগোচ্ছে এবং আমাদের অবশ্যই এদিকে মনযোগ দেয়া দরকার।